বুধবার, ১৪ অক্টোবর, ২০১৫, ০৬:২২:৩০

`অনেক হিসাবের ফল'

`অনেক হিসাবের ফল'

আনোয়ার হোসেন : স্থানীয় সরকারব্যবস্থায় নির্বাচিত দলীয় প্রতিনিধি থাকলে রাজনৈতিক সংকট কিংবা জাতীয় নির্বাচনে সুবিধাজনক অবস্থায় থাকা যাবে—দলীয় প্রতীকে স্থানীয় নির্বাচনের সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে সরকারের মধ্যে এই বিবেচনা কাজ করেছে। বিরোধী দলের ভঙ্গুর দশা এবং প্রশাসনে শক্ত নিয়ন্ত্রণ থাকার কারণে এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে বর্তমান সময়টাকেই বেছে নেওয়া হয়েছে। তবে দলীয় প্রতীক ও মনোনীত প্রার্থীর এই ধারণা বাস্তবায়ন সরকারি দলের জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠতে পারে বলেও দলের মধ্যে আলোচনা আছে।

সরকারের একাধিক মন্ত্রী, জ্যেষ্ঠ নেতা ও কেন্দ্রীয় নেতার সঙ্গে আলাপ করে এই মনোভাব পাওয়া গেছে।

ওই নেতারা বলেন, ২০০৯ সালে সরকার গঠনের পরপরই স্থানীয় নির্বাচন দলীয় প্রতীকে করার ভাবনা এসেছে সরকারের। তখনকার স্থানীয় সরকারমন্ত্রী ও দলের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম বিভিন্ন সভা-সমাবেশের বক্তৃতায় তা উল্লেখও করেন। একাধিক দলীয় ফোরামেও বিচ্ছিন্নভাবে আলোচনা হয়েছে। আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় নেতারা মনে করেন, এই সিদ্ধান্ত সরকার ও দলের জন্য লাভজনক হবে।

আ.লীগেও নানামুখী প্রতিক্রিয়া:দুজন কেন্দ্রীয় নেতা গত বছর ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে-পরের নানা দিক বিশ্লেষণ করে সরকারের জন্য এই সিদ্ধান্ত লাভজনক হবে বলে মন্তব্য করেন

আওয়ামী লীগের একজন কেন্দ্রীয় নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, জাতীয় নির্বাচন বা রাজনৈতিক সংকট মোকাবিলার নানা ‘ম্যাকানিজম’ বা কলাকৌশল থাকে। স্থানীয় সরকারব্যবস্থা দলীয় প্রতিনিধিদের নিয়ন্ত্রণে থাকলে আস্থার জায়গা তৈরি হয়। এ জন্য শুধু স্থানীয় সরকার নয়, পেশাজীবী সংগঠনগুলোতেও দলীয় লোকদের নির্বাচিত করে সর্বত্র নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠারও পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। সাম্প্রতিক বার কাউন্সিলের নির্বাচনে নিজেদের প্যানেলকে জয়ী করতে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলামকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। তিনি এতে সফলও হন। বিএনপি-জামায়াতপন্থীরা নেতৃত্বে আছে এমন পেশাজীবী সংগঠনগুলোর দিকে নজর দেওয়া হচ্ছে।

দুজন কেন্দ্রীয় নেতা গত বছর ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে-পরের নানা দিক বিশ্লেষণ করে সরকারের জন্য এই সিদ্ধান্ত লাভজনক হবে বলে মন্তব্য করেন। তাঁরা বলেন, ২০১৩ সালে পাঁচ সিটি করপোরেশনে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা পরাজিত হন। গত বছরের উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের প্রথম দুই পর্বের ফল প্রতিকূলে যায়। এই সময়ের মধ্যে অনেক পৌর নির্বাচনেও বিএনপি-জামায়াত সমর্থিত প্রার্থীরা জয়ী হয়েছেন। কিন্তু ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর সারা দেশেই বহিষ্কার, কারাগারে প্রেরণ এবং মামলায় জেরবার হয়ে বিএনপি-জামায়াত সমর্থক সিটি ও পৌর মেয়র এবং উপজেলা চেয়ারম্যানদের অনেকের স্থানে আওয়ামী লীগের লোকজন দায়িত্ব নিয়েছেন। এখন ইউনিয়ন পরিষদ ও বাকি পৌরসভাগুলোতে আওয়ামী লীগের প্রতিনিধিদের বিজয়ী করে আনতে পারলে শক্তি বাড়বে বলে তাঁরা মনে করছেন।

অবশ্য আরেকজন কেন্দ্রীয় নেতা দলীয় প্রতীকে নির্বাচনের পরিণতি নেতিবাচক হবে বলে মনে করেন। তিনি বলেন, জনপ্রিয়তার দিক বিবেচনা করলে গত প্রায় সাত বছরে আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা বেড়েছে এমনটা ভাবা কঠিন। সে ক্ষেত্রে দলীয় প্রতীক ও দলীয় প্রার্থীর নির্বাচনে ভরাডুবির আশঙ্কা আছে। তখন কেন্দ্রীয়ভাবে সিদ্ধান্ত না থাকলেও স্থানীয়ভাবে জোর-জবরদস্তি করে ফল পক্ষে আনার প্রবণতা দেখা দিতে পারে। ক্ষেত্রবিশেষে সংঘাত-সহিংসতারও সুযোগ থাকছে। এতে সরকারের বদনাম আরও বাড়বে।

এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য নূহ-উল-আলম লেনিন প্রতিবেদককে বলেন, দলীয় প্রতীকে নির্বাচন করার ব্যবস্থা নেতিবাচকভাবে দেখার সুযোগ নেই। এটা বাস্তবায়ন হলে সব রাজনৈতিক দলেই তৃণমূল পর্যায়ে নেতাদের ক্ষমতায়ন হবে। একটা ব্যবস্থা চালু হলে কিছু সমস্যা তৈরি হতে পারে। তাই বলে গণতান্ত্রিক এই ব্যবস্থার বিরোধিতা করা ঠিক নয়।
আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী একাধিক সূত্র বলছে, সাত বছর দল ক্ষমতায় থাকার কারণে মন্ত্রী, সাংসদ, উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও স্থানীয় নেতাদের মধ্যে একাধিক বলয় তৈরি হয়েছে।

এ সময় স্থানীয় পর্যায়ে রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী নেতা যেমন তৈরি হয়েছেন, তেমনি ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা নিয়ে অনেকেই বিত্তশালী হয়ে উঠেছেন। এঁদের অনেকেই জনপ্রতিনিধি হওয়ার চেষ্টা করবেন এবং প্রভাব খাটিয়ে ও অর্থ খরচ করে দলের মনোনয়ন ও বিজয় ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করবেন। উপজেলা নির্বাচনের অভিজ্ঞতা থেকে সরকারদলীয় অনেক নেতাই মনে করেন, দলের পক্ষ থেকে এককভাবে মনোনয়ন দেওয়া অনেক ক্ষেত্রে কঠিন হয়ে পড়তে পারে। সে ক্ষেত্রে বিদ্রোহী প্রার্থী সামাল দেওয়াটাই দলের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠতে পারে।

জানা গেছে, গত সোমবার কয়েকজন মন্ত্রী মন্ত্রিসভার বৈঠকে প্রার্থী মনোনয়নের বিষয়টি দল কীভাবে সামাল দেবে তা নিয়ে আলোচনা শুরু করলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এটা তেমন সমস্যা হবে না বলে মত দেন। বৈঠক সূত্র জানায়, প্রধানমন্ত্রী বলেন, সংসদ নির্বাচনে যেমন পার্লামেন্টারি বোর্ড থাকে, তেমনি স্থানীয় নির্বাচনে প্রার্থী মনোনয়নে বোর্ড করে দেওয়া হবে। প্রত্যেক বোর্ডে একজন করে কেন্দ্রীয় নেতা থাকবেন।

অবশ্য দলীয় প্রতীকে নির্বাচন হলে কোন্দল নিরসনে সহায়ক হবে বলে মনে করেন কেউ কেউ। একজন জ্যেষ্ঠ নেতা বলেন, দলীয় প্রতীকে নির্বাচনের সিদ্ধান্তের পেছনে অনেকগুলো রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক বিষয় বিবেচনায় এসেছে। এমনিতেই এই নির্বাচনগুলো দলীয়ভাবেই হচ্ছে। বরং স্থানীয়ভাবে টাকাওয়ালা অরাজনৈতিক ব্যক্তিরা টাকার জোরে নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন। দল বদলের মাধ্যমে হঠাৎ জনপ্রতিনিধি হয়ে যাচ্ছেন। দলীয় উচ্চমহলের তত্ত্বাবধানে এবং দলীয় প্রতীকে নির্বাচন হলে হঠাৎ করে কেউ উড়ে এসে জুড়ে বসতে পারবে না। বিগত স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলোতে দেখা গেছে, একজনকে দলীয় প্রার্থী করা হলে অন্যরা বিরোধিতায় নামেন। সবাই দলের নেতা হওয়ার কারণে সমর্থক-ভোটাররাও বিভক্ত হয়ে যান। দলীয় নির্বাচন নয় বলে শাস্তিমূলক ব্যবস্থাও নেওয়া যেত না। দলীয় প্রতীকে নির্বাচন হলেও বিভক্তি থাকবে। তবে শাস্তিমূলক ব্যবস্থার ভয়ে ও মার্কা না পেয়ে অনেকেই পিছিয়ে আসবেন।

দলের একজন সাংগঠনিক সম্পাদক বলেন, নিবন্ধনের ওপর আদালতের নিষেধাজ্ঞা থাকার কারণে জামায়াতে ইসলামী দলের প্রতীক ও দলীয় প্রার্থী বাছাই করে নির্বাচন করতে পারবে না। ব্যালট পেপারে সব দলের প্রতীক থাকলেও দাঁড়িপাল্লা থাকবে না। দীর্ঘদিন এভাবে চলতে থাকলে ভোটারদের মন থেকে দাঁড়িপাল্লা প্রতীক হারিয়ে যাবে। ওই নেতা আরও বলেন, প্রতীক থাকলে প্রশাসনের জন্যও সহজ হবে কে সরকার দল সমর্থিত আর কে বিরোধী দলের প্রার্থী।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন এই প্রতিবেদককে বলেন, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সব স্তরে দলীয় নির্বাচিত প্রতিনিধি থাকাই বাঞ্ছনীয়। এখন স্থানীয় নির্বাচন দলীয়ভাবেই হয়। তাহলে আর রাখঢাক কিসের জন্য।

দলীয় একাধিক প্রার্থী ঠেকানো ও বিরোধী প্রার্থীকে সহজে চিহ্নিত করে নজরদারির জন্য সুবিধা হবে এমন আশঙ্কা সম্পর্কে তিনি বলেন, নেতিবাচক চিন্তা করলে কতভাবেই করা যায়। তবে দলীয় প্রতীকে নির্বাচন হলেও স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার তো সুযোগ থাকছেই। তাই এগুলো কোনো সমস্যা নয়।-প্রথমআলো
১৪ অক্টোবর, ২০১৫/এমটিনিউজ২৪/এস.এ.সুমন/একে

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে